আমার জন্ম গ্রামে। গাছে চড়ে, পুকুরে সাঁতার কেটে, বনে বাঁদাড়ে ঘুরে আমার শৈশবকাল কেটেছে। শহর দেখতে কেমন তা আমার জানা নেই।
বাবা শহরে চাকরি করেন বলে মাঝেমধ্যেই তার কাছে শহরের গল্প শোনা হয়। জানতে পারি শহরের বিশালতা, দালাকোঠার প্রতিযোগিতা, দিন-রাত গাড়ি-বাসের আনাগোনা । গল্পগুলি আমার ভীষন ভালো লাগত। স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমিও সাহেব সেজে বড় গাড়িতে ঘুরে বেড়াবো।
আমাদের বাড়ি ছিলো রেল স্টেশনের খুবই কাছে। মাঝেমধ্যেই শোনা যেত রেল গাড়ির কু-ঝিক ঝিক আওয়াজ এবং প্রকট হর্ণ। অন্যদের কাছে বিরক্ত লাগলেও আমার কাছে বেশ লাগতো। কেমন এক কবিতার সুমধুর ছন্দের মতো চলাচল করতো রেলগাড়িগুলো। প্রায়সই বাড়ির জানালাম আমাকে বসে থাকতে দেখা যেতো, রেল গাড়ির সেই ঝিক-ঝিক শব্দের আশায়। রেলগাড়িতে আমি কখনও চড়িনি। ছোট থাকতে একবার চড়েছিলাম। কিন্তু সে আর মনে রাখার নয়।
অনেক দিনের ইচ্ছে ছিলো রেলগাড়িতে চড়ার। কিন্তু বাবার ব্যস্ততা ও আম্মার চোখ রাঙনির কাছে সে ইচ্ছেটা মাটিচাপা পড়েছিলো, কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, আমার ইচ্ছেটা হুট করে একদিন পূরণ হয়ে গেলো, পরিক্ষা শেষে বাসায় বসে যখন অলস সময় কাটাচ্ছি, আম্মা এসে বললেন বাবা আমাদেরকে শহরে যেতে বলেছেন এবং যাতায়াতের জন্য রেলগাড়ির টিকিট কিনে পাঠিয়েছে। শহরও দেখা হবে এবং রেলেও চড়া হবে। এতো পুরোই সোনায় সোহাগা! আসার খুশি তখন দেখে কে!
কথা হলো, কালই আমরা রওয়ানা হয়ে যাবো, ঠিক ভোরবেলায়। সেই যাতে উত্তেজনার চোটে ছটফট করলাম শুধু, ঘুমোনো আর হলো না। কথামত পরেরদিন ভোরবেলা, কাপড় গুছিয়ে খাবারের বাক্স সঙ্গে নিয়ে ভ্যানগাড়িতে উঠে রওয়ানা দিলাম রেলস্টেশনের পথে। ভ্যানগাড়ি পাকা রাস্তা দিয়ে শোঁ-শোঁ করে চলছে, আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি পাশের সোনালি ধানের ক্ষেত, কাঁচা-পাকা বাড়িঘর, ঘাস খেতে খেতে যাওয়ার গরুর পাল, খালের টলটলে পানির হাতছানি, ইত্যাদি। একপ্রকার মায়া হলো গ্রামটির জন্য, যেখানে আমি প্রায় ১৪ বছর একটানা কাটিয়েছি।
রেলস্টেশনে নেমে ভীড়-ভাট্টা কোনোরকমে সরিয়ে দাঁড়ালাম প্ল্যাটফর্মের ধারে। রেলগাড়ি আসতে তখনও দেরি। এই সুযোগে স্টেশনটা খুব দেখলাম। বেশ বড় স্টেশন হওয়া সত্বেও মানুষের অভাব কোথাও নেই। কেউ হয়তো টিকিট কিনছে, কেউ সিগারেট খাচ্ছে, কেউ বা তিতিবিরক্ত হয়ে দেশের পরিস্থিতি আলাপ করছে ইত্যাদি। এ যেনো এক অদ্ভূত চিড়িয়াখানা। আমি অস্থিরতার সাথে রেলগাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। অপেক্ষার পালা শেষ হলো যখন হঠাৎ প্রকান্ড শব্দে একটি চির পরিচিত হর্ণ হাজলো। সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম এবং রেলগাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। অবশেষে ধোঁয়া উডিয়ে চলে এলো, সেই আমার রেলগাড়ি।
কিছুক্ষণের জন্য রেলগাড়ির চকচকে লোহার শরীর, কালো ও লাল রঙের পোশাক পড়া টিটি ও কয়লা তোলার শব্দে তন্ময় হয়ে পড়লাম। আম্মার ধমকে আমার হুশ ফিরলো। নিমিষের মধ্যে ব্যাগ-বোঁচকা সাথে নিয়ে আম্মার সাথে রেলগাড়িতে উঠে পাড়ে নিজস্ব সিট খুঁজে বসে পড়লাম।
ইতিমধ্যেই গরমে, ধূলোয় ও মানুষের ধাক্কা-ধাক্কিতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই সিটে হেলান দিয়ে ঝিমুতে লাগলা্ম। কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ স্টেশনমাস্টার বাঁশি বাজালেন ফুররর শব্দে। আমি জানালা দিয়ে বাইবে দেখতে লাগলাম কিভাবে সামনের মানুষগুলি দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছে যত রেলগাড়ির গতি বাড়ছে। অবশেষে স্টেশন পেরিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শহরের উদ্দ্যেশ্যে এক অনন্য যাত্রায়। আম্মার কড়া শাসানির উপেক্ষা করে আমি জানালার যাহিরে মাথা গলিয়ে দিয়ে দেখতে লাগলাম বাইরের বিশ্ব।
এগিতে যাচ্ছে ঝিক-ঝিক-ঝিক শব্দে। সাথে যোগ হয়েছে মৃদু ঝাঁকানি ও মানুষের মৃদু কোলাহল। বাইরে আমি নিষ্পাপ আনন্দের সাথে এক এক করে দেখলাম বিশাল বিশাল ভুট্টো, সবজির ক্ষেত, অন্যান্য গ্রাম-শহর। উঠলাম নদীর ওপরের উঁচু ব্রীজে, থামলাম বিভিন্ন স্টেশনে এবং হেসে পান করলাম দূর্দান্ত স্বাদের শহুরে কফি। হালকা তেতো মিষ্টি উষ্ণ পানীয়টি আমার কাছে লেগেছিলো অমৃতের মতো।
এভাবেই ঘণ্টার পর ঘন্টা চললাম বাতাসের ঝাপটা খেতে খেতে, দুলতে দুলতে ঝিক-ঝিক করে। মনে পড়ে গেলো শামসুর রহমানের প্রিয় কবিতা ঝকঝকাঝক ট্রেন চলেছে…
অবশেষে, দীর্ঘ ৬ ঘন্টা পর শহরে পৌছানোর পর বাবা আমাদেরকে গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। আম্মু তখন ক্লান্ত থাকলেও আমি ছিলাম ফুরফুরে— রেল ভ্রমণ আমার সার্থক হয়েছে।

যুননুরাইন আরহা
শিক্ষার্থী, K1 ব্যাচ
কুল্লিয়্যাহ অব দ্যা রিভিলড নলেজ অ্যান্ড লিবারেল আর্টস