মাহবুবুর রহমান
ফ্যাকাল্টি
কুল্লিয়্যাহ অব দ্যা রিভিলড নলেজ অ্যান্ড লিবারেল আর্টস
জহির রায়হান সাহিত্য সমাজে বিশেষভাবে পরিচিতি পায় তার বিখ্যাত “হাজার বছর ধরে” উপন্যাসের মাধ্যমে। কিন্তু তিনি সাহিত্য জগতে পা দিয়েছেন তারও বেশ আগে।১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস “শেষ বিকেলের মেয়ে”।
উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে কোনো ধরনের বিরক্তি,একঘেয়েমিতা ও ক্লেশ ছাড়া একধরনের কৌতুহলপূর্ণ তৃষ্ণার্ত হৃদয় নিয়ে সমাপ্ত করতে হয়।
উপন্যাসের নাম দেখে পাঠক মনে একটি নারীর দুঃখ, কষ্ট এবং সংগ্রামময় জীবনের কাল্পনিক চরিত্র ভেসে আসতে পারে। কিন্তু না, লেখক এখানে এক পিতৃহারা মধ্যবিত্ত পরিবারের রুচিশীল এবং চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক যুবকের চরম বাস্তবতার মধ্যে বসবাস করিয়ে তার স্বপ্নের নায়িকাকে পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্খা ফুটিয়ে তুলেছেন এবং কাসেদকে করেছেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।
উপন্যাসটি শুরু হয়েছে একবর্ষণ মুখর পরিবেশের মধ্যদিয়ে। বর্ষার বৃষ্টিতে রাস্তায় হাটু পানি জমাট বেঁধেছে এবং অনবরত বৃষ্টির ঢল বহিছে এরইমধ্যে কাসেদ ভিজতে ভিজতে ঘরে এসে পৌঁছালো এবং জানতে পারলো কেউ একজন অনেকক্ষণ ধরে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো এবং অবশেষে কাসেদকে না পেয়ে একটি চিঠি লিখে চলে যায়। চিঠিটি লিখেছেন জাহানারা নামে একটি মেয়ে।
কাসেদ পিতৃহারা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। পেশায় একজন কেরানি। পরিবারে আছে তার এক বৃদ্ধ মা এবং দুঃসম্পর্কের বোন নাহার। নাহার খুব স্বল্পভাষী মেয়ে। যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে তার জন্য সে কষ্ট করে মুখের বুলি খরচ করে না। বাড়ির সমস্ত কাজ সে একাই করে। নাহারের মা-বাবা মারা যাওয়াতে কাসেদের মা নাহারকে তার কাছে নিয়ে রাখেন এবং লালন-পালন করেন।
# কাসেদের জীবনে কয়েকটি বৈচিত্র্যময় নারীর আগমন ঘটে। কিন্তু কাসেদ মনে প্রাণে, ধ্যানে জ্ঞানে ভালোবাসে শুধু একজনকেই “জাহানারা “। জাহানারা একজন উচ্চবিত্ত পরিবারের ভদ্র এবং আধুনিক মেয়ে। কাসেদ এবং জাহানারা দু জনেই দু’জনকে ভালোবাসে কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারে না। একদিন কাসেদ জাহানারার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলো এবং সে জানতে পারলো আজ জাহানারার জন্মদিন। সেখানে পরিচয় হয় জাহানারার কাজিন মিলি এবং শিউলির সাথে।
শিউলি এক চমৎকার মুক্তমনা, আধুনিক এবং চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করতে সে খুব ভালোবাসে কিন্তু তার দুঃখ হলো যখনই কোনো ছেলের সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে তখনই ছেলেরা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। যা শিউলি একেবারেই পছন্দ করে না। তো জাহানারার জন্মদিনের উৎসব শেষ করে কাসেদ বাড়ি ফিরতে উদ্যোত হয় তখন শিউলি তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে বাড়ি যাচ্ছেন বুঝি? কাসেদ উত্তর দেয় “হ্যাঁ”। তখন শিউলি তার সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তাব করে কেননা কাসেদের বাসার নিকটেই শিউলির বাসা। অথচ কাসেদ এটা জানতো না এজন্য কিছুটা আশ্বর্যান্বিত হলো। শিউলির শিশুসুলভ আচরণ ও চঞ্চলতা কাসেদকে মুগ্ধ করে এবং ধীরে ধীরে তাদের ভিতর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
পাঠকের কাছে শিউলির আচরণে মনে হবে শিউলি কাসেদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
এরই মাঝে একদিন উপস্থিত হয় ” সালমা”। কাসেদের খালাতো বোন সালমা। ছোটবেলা থেকেই কাসেদকে প্রচন্ডরকমের ভালোবেসে গেছেন কিন্তু ভালোবাসলেই তো আর সবসময় ঘর বাধা হয় না!তেমনি কাসেদের অবহেলায় সালমাও পারেনি তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে ঘর বাধতে। অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় তার, জন্ম হয় এক কন্যা সন্তানের।
অনেকদিন পর সালমা এসে তাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে বলে।
কিন্তু এবারও প্রত্যাখান করলো কাসেদ, কারন তার মনে তো শুধু জাহানারার বসবাস। কাসেদ সবসময়ই তাকে অবজ্ঞা করেছে।
শিউলি আর কাসেদের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে কাসেদ আর জাহানারার মাঝে একধরনের ভুল বোঝাবুঝি এবং দূরত্ব তৈরী হয়। ভালোবাসার মানুষটি ঢাকা পড়ে পর্দার অন্তরালে। দুজনের অভিমানের কাছে পরাজিত হয় তাদের ভালোবাসা।
জাহানারার কাছ থেকে ব্যর্থ হয়ে শিউলির কাছে গিয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। শিউলি অপমানসূচক বাক্যে ফিরিয়ে দিয়ে বলে “সব ছেলেরাই এক”। তাকে বন্ধু হিসাবেই দেখে। শিউলির নিকট থেকেও কাসেদ প্রচন্ড করমের আঘাত পায়। ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখতে পায় তার মা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে এবং সে রাতেই মারা যায়।
এই মূহুর্তটি পাঠকে ব্যাপকভাবে ব্যথিত করবে।
মায়ের মৃত্যুর কিছু দিন আগে থেকেই নাহারের বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা চলছিলো। কিছুদিন পর নাহারের বিয়ে দেওয়ার জন্য কাসেদের খালু এসে নাহারকে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়। কাসেদের সমস্তদিন নিজেকে শূন্য একাকীত্ব আর নির্জনতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। কাসেদের পৃথিবীটা আজ শূন্য, বড্ড শূন্য!আজ তার ঘরে,বাইরেও কেউ নেই। শেষ বিকেলে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের খেলা দেখে আর ভাবতে থাকে কত কথা!
হঠাৎ দরজাতে করাঘাত! একটি মেয়ের করাঘাত!
কে এই শেষ বিকেলের মেয়েটি?
ভাবতে থাকে কাসেদ। জাহানারা কি তাহলে তার ভুল বুঝতে পেরে তার ভালোবাসাকে সমর্পণ করতে এসেছে? নাকি শিউলি তার বন্ধুত্বের ফাঁকে ভালবেসে ফেলেছে? নাকি সালমা তার সংসার ছেড়ে ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পেতে চায়ছে?
দরজা খুলতেই কাসেদ হতভম্ব হয়ে যায় এ কি নাহার!
নাহার তোমার কাল বিয়ে আর আজ হঠাৎ এখানে আসার মানে কি?
নাহার ক্ষণকাল কাসেদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো আমার বিয়ে হয়ে গেছে এবং যার সাথে হয়েছে তার কাছেই এসেছি। কাসেদ বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওর হলুদ মাখা মুখের দিকে। আর ভাবতে থাকে সেই চাপা স্বল্পভাষী মেয়েটা আজ হঠাৎ এমন মুখরা হয়ে উঠলো কেমন করে?